মৃত্যু স্বপ্ন সংকল্প-জীবনানন্দ দাশ

আঁধারে হিমের আকাশের তলে
এখন জ্যোতিষ্কে কেউ নেই।
সে কারা কাদের এসে বলেঃ
এখন গভীর পবিত্র অন্ধকার;
হে আকাশ, হে কালশিল্পী, তুমি আর
সূর্য জাগিয়ো না;
মহাবিশ্বকারুকার্য, শক্তি, উৎস, সাধঃ
মহনীয় আগুনের কি উচ্ছিত সোনা?
তবুও পৃথিবী থেকে-
আমরা সৃষ্টির থেকে নিভে যাই আজঃ
আমরা সূর্যের আলো পেয়ে
তরঙ্গ কম্পনে কালো নদী
আলো নদী হয়ে যেতে চেয়ে
তবুও নগরে যুদ্ধে বাজারে বন্দরে
জেনে গেছি কারা ধন্য,
কারা স্বর্ণ প্রাধান্যের সূত্রপাত করে।
তাহাদের ইতিহাস-ধারা
ঢের আগে শুরু হয়েছিলো;
এখনি সমাপ্ত হতে পারে,
তবুও আলেয়াশিখা আজো জ্বালাতেছে
পুরাতন আলোর আঁধারে।
আমাদের জানা ছিলো কিছু;
কিছু ধ্যান ছিলো;
আমাদের উৎস-চোখে স্বপ্নছটা প্রতিভার মতো
হয়তো-বা এসে পড়েছিলো;
আমাদের আশা সাধ প্রেম ছিলো;- নক্ষত্রপথের
অন্তঃশূন্যে অন্ধ হিম আছে জেনে নিরে
তবুও তো ব্রহ্মান্ডের অপরূপ অগ্নিশিল্প জাগে;
আমাদেরো গেছিলো জাগিয়ে
পৃথিবীতে;
আমরা জেগেছি-তবু জাগাতে পারি নি;
আলো ছিলো- প্রদীপের বেষ্টনী নেই;
কাজ ছিল- শুরু হলো না তো;
হাহলে দিনের সিঁড়ি কি প্রয়োজনের?
নিঃস্বত্ব সূর্যকে নিয়ে কার তবে লাভ!
সচ্ছল শাণিত নদী, তীরে তার সারস-দম্পতি
ঐ জল ক্লান্তিহীন উৎসানল অনুভব ক’রে ভালোবাসে;
তাদের চোখের রং অনন্ত আকৃতি পায় নীলাভ আকাশে;
দিনের সূর্যের বর্ণে রাতের নক্ষত্র মিশে যায়;
তবু তারা প্রণয়কে সময়কে চিনেছে কি আজো?
প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কে এসে চেনায়!
মারা মানুষ ঢের ক্ররতর অন্ধকূপ থেকে
অধিক আয়ত চোখে তবু ঐ অমৃতের বিশ্বকে দেখেছি;
শান্ত হয়ে স্তব্ধ হয়ে উদ্বেলিত হয়ে অনুভব ক’রে গেছি
প্রশান্তিই প্রাণরণনের সত্য শেষ কথা, তাই
চোখ বুজে নীরবে থেমেছি।
ফ্যাক্টরীর সিটি এসে ডাকে যদি,
ব্রেন কামানের শব্দ হয়,
লরিতে বোঝাই করা হিংস্র মানবিকী
অথবা অহিংস নিত্য মৃতদের ভিড়
উদ্দাম বৈভবে যদি রাজপথ ভেঙে চ’লে যায়,
ওরা যদি কালোবাজারের মোহে মাতে,
নারীমূল্যে অন্ন বিক্রি ক’রে,
মানুষের দাম যদি জল হয়, আহা,
বহমান ইতিহাস মরুকণিকার
পিপাসা মেটাতে
ওরা যদি আমাদের ডাক দিয়ে যায়-
ডাক দেবে, তবু তার আগে
আমরা ওদের হাতে রক্ত ভুল মৃত্যু হয়ে হারায়ে গিয়েছি?
জানি ঢের কথা কাজ স্পর্শ ছিলো, তবু
নগরীর ঘন্টা-রোল যদি কেঁদে ওঠে,
বন্দরে কুয়াশা বাঁশি বাজে,
আমরা মৃত্যুর হিম ঘুম থেকে তবে
কী ক’রে আবার প্রাণকম্পনলোকের নীড়ে নভে
জ্বলন্ত তিমিরগুলো আমাদের রেণুসূর্যশিখা
বুখে নিয়ে হে উড্ডীন ভয়াবহ বিশ্বশিল্পলোক,
মরণে ঘুমোতে বাধা পাব?-
নবীন নবীন জঞ্জাতকের কল্লোলের ফেনশীর্ষে ভেসে
আর একবার এসে এখানে দাঁড়াব।
যা হয়েছে- যা হতেছে- এখন যা শুভ্র সূর্য হবে
সে বিরাট অগ্নিশিল্প কবে এসে আমাদের ক্রোড়ে ক’রে লবে।

স্বপ্নের হাত - জীবনানন্দ দাশ

পৃথিবীর বাধা — এই দেহের ব্যাঘাতে
হৃদয়ে বেদনা জমে — স্বপনের হাতে
আমি তাই
আমারে তুলিয়া দিতে চাই।
যেই সব ছায়া এসে পড়ে
দিনের রাতের ঢেউয়ে — তাহাদের তরে
জেগে আছে আমার জীবন;
সব ছেড়ে আমাদের মন
ধরা দিত যদি এই স্বপনের হাতে!
পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে
বেদনা পেত না তবে কেউ আর —
থাকিত না হৃদয়ের জরা —
সবাই স্বপ্নের হাতে দিত যদি ধরা!
আকাশ ছায়ার ঢেউয়ে ঢেকে
সারাদিন — সারা রাত্রি অপেক্ষায় থেকে
পৃথিবীর যত ব্যথা — বিরোধ, বাস্তব
হৃদয় ভুলিয়া যায় সব
চাহিয়াছে অন্তর যে ভাষা,
যেই ইচ্ছা, যেই ভালোবাসা,
খুঁজিয়াছে পৃথিবীর পারে পারে গিয়া —
স্বপ্নে তাহা সত্য হয়ে উঠেছে ফলিয়া!
মরমের যত তৃষ্ণা আছে —
তারই খোঁজে ছায়া আর স্বপনের কাছে
তোমরা চলিয়া আস —
তোমরা চলিয়া আস সব!
ভুলে যাও পৃথিবীর ঐ ব্যথা — ব্যাঘাত — বাস্তব!
সকল সময়
স্বপ্ন — শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
যাদের অন্তরে–
পরস্পরে যারা হাত ধরে
নিরালা ঢেউয়ের পাশে পাশে
গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে
যাহাদের আকাঙক্ষার জন্ম মৃত্যু — সব
পৃথিবীর দিন আর রাত্রির রব
শোনে না তাহারা!
সন্ধ্যার নদীর জল, পাথরে জলের ধারা
আয়নার মতো
জাগিয়া উঠিছে ইতস্তত
তাহাদের তরে।
তাদের অন্তরে
স্বপ্ন, শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
সকল সময়!…
পৃথিবীর দেয়ালের পরে
আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে
একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা —
সে সব ব্যর্থতা
আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া!
দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে
ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়া
হৃদয়ের আকাঙক্ষার নদী
ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় — ঢেউ তুলে তুপ্তি পায় যদি —
তবে ঐ পৃথিবীর দেয়ালের পরে
লিখিতে যেয়ো না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে
অন্তরের কথা! —
আলো আর অন্ধকারে মুছে যায় সে সব ব্যর্থতা!
পৃথিবীর অই অধীরতা
থেমে যায়, আমাদের হৃদয়ের ব্যথা
দূরের ধুলোর পথ ছেড়ে
স্বপ্নেরে — ধ্যানেরে
কাছে ডেকে লয়
উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়
মানুষেরও আয়ূ শেষ হয়
পৃথিবীর পুরানো সে পথ
মুছে ফেলে রেখা তার —
কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ
চিরদিন রয়!
সময়ের হাত এসে মুছে ফেলে আর সব —
নক্ষত্রেরও আয়ু শেষ হয়!

যতিহীন - জীবনানন্দ দাশ

বিকেলবেলা গড়িয়ে গেলে অনেক মেঘের ভিড়
কয়েক ফলা দীর্ঘতম সূর্যকিরণ বুকে
জাগিয়ে তুলে হলুদ নীল কমলারঙের আলোয়
জ্ব’লে উঠে ঝরে গেল অন্ধকারের মুখে।
যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে,-
মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথে
কোথায় আছে জানি না তো;
কোথায় সমাজ, অর্থনীতি? স্বর্গগামী সিঁড়ি
ভেঙে গিয়ে পায়ের নিচে রক্তনদীর মতো-
মানব ক্রমপরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী
হয়ে কি আজ চারিদিকে গণনাহীন ধূসর দেয়াল
ছড়িয়ে আছে যে যার দ্বৈপসাগর দখল ক’রে!
পুরাণপুরুষ, গণমানুষ, নারীপুরুষ, মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব
অর্থবিহীন হয়ে গেলে,-তবু আরেক নবীনতর ভোরে
সার্থকতা পাওয়া যাবে ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হ’য়ে
পথে-পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে
তবুও কেবল দ্বীপ বানালো যে যার নিজের অবক্ষয়ের জলে।
প্রাচীন কথা নতুন ক’রে এই পৃথিবীর অনন্ত বোনভায়ে
ভাবছে একা-একা ব’সে
যুদ্ধ রক্ত রিরংসা ভয় কলরোলের ফাঁকেঃ
আমাদের এই আকাশ সাগর আঁধার আলোয় আজ
যে-দোর কঠিন; নেই মনে হয়; সে-দ্বার খুলে দিয়ে
যেতে হবে আবার আলোয় অসার আলোর ব্যাসন ছাড়িয়ে।

সে - জীবনানন্দ দাশ

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলোঃ ‘এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।’
‘এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?’
মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।
সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসে
মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক – তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।

বাংলার মুখ - জীবনানন্দ দাশ

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতো ব্ড় পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দয়েলপাখি – চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ
দেখেছিল; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে –
কৃষ্ণা-দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায় –
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিল – একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদ-নদী-ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।

যদি আমি ঝরে যাই একদিন - জীবনানন্দ দাশ

যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;
যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,
যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুজে,
যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়,
যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,
শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-
তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,
ঠেস্‌ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,
তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান-
যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড়
একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর,
যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;-
কবে যে আসিবে মৃত্যু; বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান-
রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে ম্লান।